ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

গোমাতলী সড়কে গাড়ী চলেনা চলেনা, চলে নারে…..

gomatali-road-1_1সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও (কক্সবাজার) :

গত ৪ মাস ধরে বেড়ীবাঁধ ভাঙ্গে- ডুবে প্রতিনিয়তই অভাব আর সীমাহীন দারিদ্রতার কবলে ক্ষুধার হাহাকার আর নানা রোগ শোক জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে তাদের, তবুও থেgomatali-road-2_1মে থাকে না জীবন সংগ্রাম কক্সবাজার সদর উপজেলার উপকূলীয় পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীর মানুষদের । সড়কের গোমাতলীর সঙ্গে কক্সবাজার সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সড়কটি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে। এরপর থেকে ঝুঁকি নিয়ে বর্ষা মৌসুমে কোন রকমে নৌকা করে পার হয়ে সড়কের আরেক পাশে উঠতে হয়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় ওই এলাকার মানুষকে চরম দূভোর্গ পোহাতে হলেও এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

গতকাল বধুবার সকালে কথা হয় ইউনিয়নের গোমাতলীর আশার সঙ্গে। ভারী বর্ষণ উপেক্ষা করে সড়কের ভাঙা অংশ পাড়ি দিতে আশা তখন অপেক্ষায় ছিলেন নৌকার জন্য। সঙ্গে ছিলেন ৩ বছর বয়সের এক ছেলে। আশার মতো এই কষ্ট এখন গোমাতলীর ১০ গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষের।

পোকখালী ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দুখু মিয়া বলেন, ঈদগাঁও থেকে গোমাতলীর দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার হলেও বিধ্বস্থ এই ভাঙ্গা অংশের কারনে বর্তমানে এই ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কয়েক গুন অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি কয়েক ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। তার উপর নৌকা, সিএনজি নিয়ে কয়েকদফা গাড়ী বদলিয়ে আসা যাওয়া সেই প্রাচীন যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় এলাকাবাসীকে। ১২ কিলোমিটার মধ্যে ৪কিলোমিটার অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়েছে। ফলে এলাকার লোকজনকে নৌকা দিয়ে পারাপার হতে হচ্ছে।

সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বাহাদুর বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে গোমাতলীর অধিকাংশ বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ভাড়া বাসায় থাকছেন। নানা চেষ্টা তদবির করে ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামত করার জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হলেও এখনও কোন ধরনের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখা মিলেনি। তার উপর ক্ষত-বিক্ষত সড়ক মেরামতের কোন ধরনের গরজ নেই সড়ক বিভাগের। ক্ষত-বিক্ষত সড়ক জোড়া লাগবে কবে তা বলা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পোকখালী ইউনিয়নের তিনটি ওযার্ডের গোমাতলীর অংশের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়ে আসছে। ওই সময় যোগাযোগে একমাত্র প্রধান সড়কটিও পানিতে নিমজ্জিত। স্থানীয় লোকজন নৌকা নিয়ে চলাচল করছেন। তাই গোমাতলীর গ্রামের ২০ হাজার মানুষকে দূভোর্গ পোহাতে হচ্ছে।

গোমাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ৪ মাস ধরে গোমাতলীর সঙ্গে সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এলাকার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বলেন, এখানে উৎপাদিত ফসল ও আহরিত মাছের ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পেরে স্থানীয় চাষি ও জেলেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।

উপকূলীয়ঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাঙ্গা বেড়ীবাঁধ, ভুমিক্ষয়, বন্যা আর দারিদ্র্যেরে কষাঘাতে জর্জরিত এ জনপদের সহস্রাধিক অসহায় নারী পুরুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করছে। বিশেষ করে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি এসব এলাকায় ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করে। জোয়ারের পানিতে হাজার হাজার ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। কর্ম ও আয় রোজগারহীন দরিদ্র ভূমিহীন হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় না মাছ ধরা, থাকে না কোন দিন মজুরের কাজ। এ কারণে অকাল লেগে যায়। নিরুপায় অনেকেই গরু ছাগল, হাঁস-মুরগী, বিক্রি করে কিছুদিন সংসার চালান। ভুমিহীন নিঃস্ব দিন মজুররা মানবেতর জীবন যাপন করেন। অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটিয়ে অপুষ্টিজনিত কারনে রোগাক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যু বরণ করেন। ভাঙ্গা বেড়ীবাঁধ বারংবার জোয়ারের পানি এদের এখন নিত্য সঙ্গী।

এদিকে র্ঘূণিঝড় রোয়ানুর পর থেকে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গন-প্লাবন এবং জীবন সংগ্রামের সাথে অবিরত সংগ্রামরত সদর উপজেলার উপকূলীয় পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীর বসবাসরত মানুষেরা। এর পরেও তারা জীবনের কাছে হার মানতে নারাজ। সাগরের জোয়ারের পানি অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জোয়ার আসলে ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হয় আশ্রয়স্থলে। পরে পানি নেমে গেলে আশ্রয় ছেড়ে এসব মানুষ ফিরে যায় ঘরে। তবে কাপড়-চোপড়, বিছানা নষ্ট, বাড়ীর মেঝে স্যাঁত-স্যাঁতে হওয়ায় রান্নার পাশাপাশি রাত্রী যাপন করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। প্লাবিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ এসব মানুষ রয়েছে চরম দূর্ভোগে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বসতবাড়ী ও গাছপালা। পোকখালী উপকূলীয় বেড়ীবাধ ভেঙ্গে হাজার হাজার একর চিংড়ী প্রজেক্টের ক্ষতির পাশাপাশি সড়ক উপসড়ক ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে গেছে অনেকের বসতবাড়ী, ক্ষেত খামার ,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ী, শিক্ষা প্রতিষ্টান, সড়ক উপসড়ক, মৎস্য প্রজেক্ট।

পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর পর থেকে সরকারী ভাবে আর কোন বরাদ্দ আসে নাই। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য বাজেট দিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্টান বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ নেয়নি। বাজেট দেয়া হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অগ্রিম টাকা না পাওয়াতে ঠিকাদাররা এ কাজ নিতে চাইছেন না।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গোমাতলী সড়ক দিয়ে হাজারো মানুষের নিত্য যাতায়াত। গোমাতলীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দূর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। উপজেলার উপকূলীয় পোকখালী ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গোমাতলীর অবস্থান। আদতে এটি কোন দ্বীপ না হলেও গত ৪মাস ধরে বেড়ীবাঁধ ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানকার মানুষেরা দ্বীপের মানুষের মতো জীবন যাপন করে যাচ্ছে। একদিকে বেড়ীবাঁধ না থাকায় প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটায় বসবাস করছে হাজারো মানুষ। অপরদিকে ৪ কিলোমিটার বিধ্বস্থ সড়ক পাড়ি দিতে দুই দফা নৌকা আর হেটে কাঁদা মাখা পথ মাড়িয়ে ১২ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরের ঈদগাঁও পৌঁছানো এখানকার মানুষদের কাছে মহাকষ্ঠকর হচ্ছে।

সুত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা বড় বিপদে বেড়িবাঁধ, সড়ক , আশ্রয়কেন্দ্র সবই নিরাশ করছে গোমাতলীর বাসিন্দাদের। ৪ মাস ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে ২০ হাজার মানুষের বসতিস্থল গোমাতলী। বেড়ীবাঁধ বিলীন হয়ে ধীরে ধীরে ৫ গ্রাম সম্পূর্ন বিলীন হয়েছে। ৩’শ পরিবারের বসত ভিটা বিলীন হয়ে অন্তত ২ হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্ধাস্তুতে পরিণত হয়েছে। উদ্ধাস্তুতে পরিনত হওয়া এসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববতী ঈদগাঁওর পাহাড়ী এলাকাসহ বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। বেড়ীবাঁধ নির্মিত না হওয়ার ফলে এ এলাকার ২০ হাজার মানুষের জলবায়ু উদ্ধাস্তুতে পরিণত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। গোমাতলীতে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ক্ষতির প্রভাবটা পড়েছে। পশ্চিমের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ হয়ে বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাটার বৃত্তে বন্দী রয়েছে এ এলাকার মানুষ।

এদিকে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনের পর থেকে ঈদগাঁও থেকে গোমাতলীর যোগাযোগের প্রধান সড়কটি জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে জোয়ারের সময় নৌকায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়। ভাটার সময় এ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। বিকল্প আর কোন উপায় না থাকায় যে কোন দূর্যোগকালীন সময়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের সুযোগ নেই এলাকার মানুষের। অন্যদিকে বৃহত্তর গোমাতলীর প্রায় ২০ হাজার মানুষের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৫ টি। এসবের আনুমানিক ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১ হাজারের বেশি নয়।

এ বিষয়ে পোকখালী ইউপি মেম্বার আলাউদ্দিন জানান, এলাকায় যে আশ্রয় কেন্দ্র গুলো রয়েছে তাতে দূর্যোগকালীন সময়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার মত মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। ২০ হাজার বাসিন্দা অধ্যুষিত বৃহত্তর এই জনপদের জন্য তা অত্যন্ত নগন্য।

গোমাতলী উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দরা জানান, বছর বছর গোমাতলীর দূর্ভোগ আর শেষ হচ্ছেনা। বিগত ৪ মাস ধরে এ দূর্ভোগ দূর্দশা থেকে নিস্কৃতি চায় গোমাতলীবাসী। গোমাতলী ২০ হাজার মানুষের এখন প্রানের ও বাঁচার দাবী বেড়ী বাঁধ নির্মাণ,এজন্য তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সবিবুর রহমান জানান, উপকূলীয় গোমাতলীতে একটি রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। রিং বাঁধটি নির্মিত হলে দূর্ভোগের অবসান হবে বলে মনে করেন তিনি।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধ নির্মিত না হওয়ায় সড়কের ওই ৪ কিলোমিটার ক্ষত-বিক্ষত ভাঙা অংশ নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কবে নাগাদ, ক্ষত-বিক্ষত সড়ক জোড়া লাগবে সেটা বলা মুশকিল।

 

পাঠকের মতামত: